Bir Chandra Manikya. আধুনিক ত্রিপুরার পথপ্রদর্শক মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য ।
বীরচন্দ্রমাণিক্য ঈশানচন্দ্রমাণিক্য ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ১ লা আগস্ট পরলোক গমন করলে তাঁর ভ্রাতা বীরচন্দ্র ত্রিপুরার রাজা হন । কিন্তু তাঁর অপর দুই ভ্রাতা চক্ৰধ্বজ ও নীলকৃষ্ণ ঠাকুর ত্রিপুরার সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসাবে দাবি করে বীরচন্দ্রের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হন । মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর বীরচন্দ্রকে ডিফেক্টো বা কার্যত রাজা বলে স্বীকার করেন । ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই মার্চ প্রিভিকাউন্সিল বীরচন্দ্রের স্বপক্ষে রায় দিলে ইংরেজ সরকারের অনুমতি লাভ করে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ই মার্চ মহাসমারোহে বীরচন্দ্রমাণিক্যের অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় । তিনি ১২৫ টি স্বর্ণমুদ্রা ব্রিটিশ সরকারকে নজর প্রদান করেছিলেন । ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার বীরচন্দ্রমাণিক্যকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন । অবশ্য মহারাজা উপাধিটি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া হয় , তাঁর বংশধরদের জন্য নয় । খেলাত ও মহারাজা উপাধি প্রাপ্তির জন্য বীরচন্দ্রমাণিক্যকে ব্রিটিশ সরকারকে তিন হাজার টাকা নজর প্রদান করতে হয়েছিল ।
ইতিমধ্যে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজকর্মচারীদের অত্যাচারে উত্ত্যক্ত হয়ে জামাতিয়া সম্প্রদায় সর্দার পরীক্ষিতের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু করে । বীরচন্দ্রমাণিক্য দুর্দান্ত কুকিদের সাহায্যে কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেন । ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের এক সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘ স্বাধীন ত্রিপুরার ’ স্থলে ‘ পার্বত্য ত্রিপুরা ’ সরকারি কাগজ পত্রে লিখিত হতে থাকে । এর ফলে ত্রিপুরার রাজ্যের ক্ষেত্রে সম্মানজনক ' স্বাধীন ' কথাটির বিলোপ ঘটে । ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চের ভারত সরকারের ‘ নজরানা রিজলিউশন ' অনুযায়ী ত্রিপুরার রাজার মৃত্যুর পর পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করলে ত্রিপুরা রাজ্যের এক বৎসরের রাজস্বের অর্ধাংশ এবং পুত্র ব্যতীত অন্য ব্যক্তি উত্তরাধিকারী হলে এক বৎসরের সমস্ত রাজস্ব নজর প্রদান করতে হবে বলে স্থির হয় ।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে দুইশত থেকে তিনশত কুকি সম্প্রদায়ের লোক ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং হত্যা ও লুঠতরাজ চালায় । এর পর তারা কাছাড় ও শ্রীহট্ট জেলায় প্রবেশ করে কিছু ইংরেজ হত্যা , লুঠতরাজ ও কিছু লোককে বন্দি করে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায় । ব্রিটিশ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা ও কুকি বা লুসাই উৎপাত স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কুকিদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক অভিযান চালান । বীরচন্দ্রমাণিক্য এই অভিযানে নানাভাবে সাহায্য করেন । ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধক্রমে সীমান্তে কয়েকটি চৌকি স্থাপন করেন এবং একদল সৈন্য সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত রাখেন । এই অভিযানের সময় ত্রিপুরার পূর্ব সীমান্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে আনা হয় এবং তা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘোষণা বলে স্থায়ী ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় ।
ব্রিটিশ সরকারের সীমান্তে স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা জুলাই এ . বলিউ বি . পাওয়ার আগরতলায় ত্রিপুরার প্রথম পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হন । এ ব্যাপারে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ত্রিপুরা রাজকে এই বলে আশস্ত করেছিলেন যে পলিটিক্যাল এজেন্ট নিয়োগের ফলে ত্রিপুরা রাজ্যের স্বার্থের কোনো হানি হবে না । ত্রিপুরার রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না । বীরচন্দ্রমাণিক্য অবশ্য এই নিযুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন । ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের আগরতলায় পলিটিক্যাল এজেন্টের নিয়োগ রদ করা হয় এবং জেলা ত্রিপুরার ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এক্স অফিশিও বা পদাধিকার বলে পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হন । তাঁর অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উমাকান্ত দাসকে আগরতলায় সহকারী পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত করা হয় । ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে স্থির হয় যে মহারাজা পলিটিক্যাল এজেন্টের পরামর্শ নিয়ে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে একজন মন্ত্রী নিয়োগ করবেন । এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায় উমাকান্ত দাস বাহাদুর ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ত্রিপুরার মন্ত্রী নিযুক্ত হন । এরপর ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজকে প্রশাসনিক ক্ষমতা ফেরত দেওয়া হয় এই শর্তে যে তিনি প্রতি বৎসর বার্ষিক রিপোর্ট সরবরাহ করবেন এবং কমিশনার কুমিল্লা এলে প্রতি বৎসর নিজে অথবা যুবরাজ ও বড়ঠাকুর কুমিল্লায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন । আগরতলায় সহকারী পলিটিক্যাল এজেন্টের পদ বিলোপ করা হল।
মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্যের রাজত্বকালে ত্রিপুরা আধুনিক যুগে প্রবেশ করে । আইন , প্রশাসন , শিক্ষা , সমাজ , সংস্কার প্রভৃতি সকল দিক থেকেই ত্রিপুরাকে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় । এ ব্যাপারে মহারাজার ব্যক্তিগত আগ্রহের চাইতে ত্রিপুরায় নিযুক্ত ব্রিটিশ প্রশাসনে অভিজ্ঞ কিছু কর্মচারী ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিশেষ প্রচেষ্টায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয় । আগরতালয় পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হবার পর তাঁর উপদেশ অনুসারে বিচার বিভাগের সংস্কার সাধিত হয় । চাকলা রোশনাবাদের দেওয়ান ঈশানচন্দ্র গুপ্তের তত্ত্বাবধানে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়ক সংক্ষিপ্ত নিয়মাবলী ( আইন ) প্রণীত হয় । পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যে সুসংবদ্ধভাবে লিখিত আইন ছিল না । পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যে দেওয়ানি ও ফৌজদারি সংক্রান্ত বিচারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি রাজা নিজে করতেন । ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সব মোকদ্দমার বিচারের জন্য প্রিভি কাউন্সিলের অনুকরণে খাস আদালত নামে একটি বিচারালয় স্থাপিত হয় । মঞ্জুরি দানের ক্ষমতা রাজার হাতে রাখা হয় । খাস আদালতের জন্য দুজন বিচারক নিযুক্ত হন । ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে নীলমণি দাস ত্রিপুরা রাজ্যের সর্ব ক্ষমতাযুক্ত দেওয়ান নিযুক্ত হলে আইন ও প্রশাসনিক সংস্কারের গতিবেগ আরও বৃদ্ধি পায় । তিনি কার্যভার গ্রহণ করে ব্রিটিশদের অনুকরণে আবগারী ( মাদক দ্রব্য সংক্রান্ত ) বিভাগ , স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন , দলিল রেজিস্টারি নিয়ম প্রবর্তন করেন । তিনি দেওয়ানি ও ফৌজদারি সংক্রান্ত আইন সংশোধন এবং তামাদি আইন প্রণয়ন করেন । ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরায় নরহত্যাকারীকে প্রথম ফাঁসি দ্বারা প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় । তিনি উকিলদের পরীক্ষার প্রথাও প্রবর্তন করেন । ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার পার্বত্য প্রজার জন্য ‘ পাহাড় আদালত ’ নামক বিচারালয় রদ করে রাজ্যের সকল প্রজাকে একই বিচার ব্যবস্থার অধীনে আনা হয় ।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মোহিনীমোহন বর্ধন মন্ত্রী নিযুক্ত হলে ( দুই বৎসরের শাসনকালে ) তাঁর সময়ে চিফ জাস্টিসের পদ সৃষ্টি করে যুবরাজকে খাস আপিল আদালতের প্রধান বিচারপতি মনোনীত করা হয় । মোহিনীবাবু প্রজাস্বত্ব বিষয়ক আইন , কর্মচারীদের বিদায় সম্বন্ধীয় আইন ও নাবালকদের সম্পত্তি রক্ষা বিষয়ক বিধান প্রভৃতি আইন চালু করেন । প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধিত হল । তিনি মন্ত্রিপদের সৃষ্টি করে তাঁকেই প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দান করেন । রাজ্যের ব্যয় সীমিত করার জন্য বাজেট প্রবর্তনের চেষ্টা করা হল । প্রশাসনের সুবিধার জন্য ত্রিপুরা রাজ্যকে তিনি ভাগে বিভক্ত করা হল । উত্তর বিভাগ , মধ্য বিভাগ ও দক্ষিণ বিভাগ । বিভাগগুলির প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল যথাক্রমে কৈলাসহর , আগরতলা ও উদয়পুর ( পরে সোনামুড়া ) । সেনাবাহিনীকেও আধুনিকভাবে সুশিক্ষিত করা হল ।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে আগরতলায় মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপিত হয় । প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হল ত্রিপুরার পলিটিক্যাল এজেন্ট । সারা ভারতের সঙ্গে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ত্রিপুরাতেও লোকগণনা বা সেন্সাস কার্য আরম্ভ হয় । ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর স্থাপিত হয় আগরতলায় ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম পোস্ট অফিস । ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে স্থাপিত হয় আগরতলায় নতুন হাবেলি দাতব্য চিকিৎসালয় । ইংরেজি শিক্ষার জন্য কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম হাইস্কুল “ আগরতলা সরকারি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ” প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই ডিসেম্বর । এই স্কুলটিই পরবর্তী কালে ( ১৯০৪ খ্রিঃ অব্দ থেকে ) উমাকান্ত একাডেমি নামে পরিচিত হয় । মহারাজ বীরচন্দ্রমাণিক্যই প্রথম রাজ্যবাসীর শিক্ষার দায়িত্ব সরকারি ভাবে গ্রহণ করেন । এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এই যে বীরচন্দ্রমাণিক্যের আমলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ব্যবহার করা হয় । মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্যের আমলে ত্রিপুরায় দাস ও সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ সাধিত হয় । ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের আইনে ভারতে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হলেও ত্রিপুরায় তা অব্যাহত থাকে । শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের অনুরোধ ক্রমে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য ত্রিপুরায় ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করে দেন । সতীদাহ প্রথাও ত্রিপুরায় অতি প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত ছিল । ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক এক ঘোষণা বলে ভারতে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন । কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্যে এই প্রথা অব্যাহত থাকে । ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকারের নির্দেশ অনুসারে চট্টগ্রামের কমিশনার লায়াল ত্রিপুরার এসিস্ট্যান্ট উমাকান্ত দাসকে এ ব্যাপারে চিঠি লেখেন । মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য সতীদাহ প্রথা বিলোপের পক্ষপাতী ছিলেন না । রাজদরবারের সঙ্গে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ বাক্বিতণ্ডার পর এসিস্ট্যান্ট পলিটিক্যাল এজেন্ট উমাকান্ত দাসের মধ্যস্থতায় ও মন্ত্রী মোহনীমোহন বর্ধনের উদ্যোগে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মে এক ঘোষণা দ্বারা ত্রিপুরায় সতীদাহ প্রথান নিষিদ্ধ করা হয় । ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ত্রিপুরি সম্প্রদায়কে রাজপরিবারের মতো হিন্দু ক্ষত্রিয় পর্যায়ভুক্ত করার চেষ্টা হলে মহারাজা এতে বিশেষ উৎসাহ দেন । বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন । যেসব কর্মচারী এর বিরোধিতা করেছিল তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয় । বিক্রমপুর থেকে কিছু পণ্ডিত এনে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা হয় । শেষ পর্যন্ত কয়েক বৎসরের মধ্যে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় ।
মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । তিনি বাংলা , উর্দু , মণিপুরি এবং ত্রিপুরি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতনে । ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষাতেও তাঁর জ্ঞান ছিল । তিনি আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং বিজ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন পুস্তকাদি নিয়মিত পাঠ করতেন । তিনি একজন সুনিপুণ চিত্রকর ও ফটোগ্রাফার ছিলেন । সঙ্গীতশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল । তিনি একজন কবি ও কাব্য রসিক ছিলেন এবং বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন । তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ প্রেমমরীচিকা ’ , ‘ আকালকুসুম ’ , ‘ উচ্ছ্বাস ’ , “ ঝুলন ’ ইত্যাদি । তাঁর সমসাময়িক ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন , “ তিনি নিজে যেমন গুণী ছিলেন তেমনি জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদেরও সমাদর করতেন । তাঁর দরবারে বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটেছিল । বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত গায়ক যদুভট্ট তাঁর দরবারে সমাদৃত হয়েছিলেন । বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি অনুরাগী বীরচন্দ্রমাণিক্য শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ প্রকাশনার জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করেন এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ দীনেশচন্দ্র সেনের ‘ বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ' গ্রন্থখানি তাঁরই অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হয় । রাজমহিয় ভানুমতী দেবীর অকালমৃত্যুতে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য যখন শোকে আচ্ছন্ন সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নহৃদয় কাব্য গ্রন্থ পাঠ করে তিনি সান্ত্বনা লাভ করেন । তিনি রাধারমণ ঘোষকে ব্যক্তিগত দূত হিসাবে কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রেরণ করে অভিনন্দন জানান এবং রবীন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে একজন বিখ্যাত কবি হবেন সে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেন । সেই সময় থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় । তাঁর কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবীও ‘ কণিকা ’ ‘ লোকগাথা ’ , ‘ প্রীতি ’ নামে কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা । পুত্র সমরেন্দ্রও কয়েকটি পুস্তক রচনা করেছিলেন । তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও জ্ঞানীগুণীর পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ করে ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন বীরচন্দ্রমাণিক্যকে বাংলার বিক্রমাদিত্য বলে অভিহিত করেছেন । হান্টার মন্তব্য করেছেন যে বীরচন্দ্রমাণিক্য প্রশাসনিক কার্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না । এগুলি তিনি দেওয়ান ও আমলাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার দিকে অধিক মনোযোগ দিয়েছিলেন । ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই ডিসেম্বর কলিকাতায় মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য পরলোক গমন করেন ।
No comments