প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্য উপাদানের গুরুত্ব নির্নয় এবং এর সীমাবদ্ধতা।
ইতিহাস মনগড়া কাল্পনিক কাহিনী নয়, ঘটে যাওয়া অতীতই হল ইতিহাস। সেই অতীতকে জানার জন্য দরকার হয় তথ্য প্রমাণের,এই তথ্য কে বলা হয় ইতিহাসের উপাদান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে প্রাচীন গ্রীস বা ইতালির মত প্রাচীন ভারতের যথার্থ ঐতিহাসিক বা সঠিক ইতিহাস ছিল না। এই কথার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের এই মন্তব্যে " সে সময় ইতিহাস চেতনা বা ইতিহাসের উপাদান কোনটারই অভাব ছিল না। অভাব ছিল বিভিন্ন তথ্য এর সাহায্যএ প্রকৃত সাহিত্য গ্রন্থ সম্পন্ন ইতিহাস রচনার উৎসাহের বা ইচ্ছার।
উপাদানের শ্রেণিবিভাগ - প্রচীন কালে ভারতের ইতিহাস রচনার ঐতিহাসিক উপাদানগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা - সাহিত্যক তথা লিখিত উপাদান ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
সাহিত্য উপাদানকে দেশীয় সাহিত্য ও বৈদেশিক পর্যটকদের বিবরন এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অন্য দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে মুদ্রা, লিপি, ও স্থাপত্য - ভাস্কর্য এই তিন ভাগাভাগি করা যায়।
দেশীয় সাহিত্যগুলিকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা ধর্মীয় গ্রন্থ, ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ, জীবনচরিত ও আঞ্চলিক ইতিহাস।
ক) ধর্মীয় গ্রন্থ - প্রাচীন কালে ভারতের অধিকাংশ গ্রন্থই
ধর্মের ভিত্তিতে লেখা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বেদ, উপনিষদ, পুরান, রামায়ণ ও মহাভারত । এছাড়াও আছে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক ও জাতক। জৈন ধর্মগ্রন্থ কল্পসূত্র, ও ভগবতী সূত্র। এসব গ্রন্থ থেকে তৎকালীন ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন স্মৃতি শাস্ত্র যথা নারদ স্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি, মনু স্মৃতি থেকে প্রাচীনভারতের নানা আর্থ-সামাজিক তথ্য পাওয়া যায়।
ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ - প্রাচীন ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ গুলি আইন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়কে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ গুলির মধ্যে কৌটিল্য এর অর্থশাস্ত্র , পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, পতঞ্জলির মহাভাষ্য প্রভৃতি নানা ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ। এছাড়াও বিভিন্ন কাব্য যেমন - কালিদাসের অভিজ্ঞআন শকুন্তলম্ , মেঘদূত বিশাখদত্তর মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য এর সন্ধান দেয়।
জীবনচরিত - প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজাদের জীবনের সমকালীন ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে লেখা জীবনচরিতগুলির মধ্যে বাণভট্টর হর্ষচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, হরিষেনের এলাহাবাদ প্রশস্তি, বাকপতিরাজ রচিত গৌড়বহ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে তৎকালীন ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
বৈদেশিক বিবরন- ভারতে আসা বৈদেশিক লেখক ও সাহিত্যিকদের বিবরন থেকে ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে যে সব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলিকে বৈদেশিক বিবরন বলা হয়। বৈদেশিক রচনাগুলিকে আমরা গ্রীক-রোমান, চৈনিক ও আরব এই তিনভাগে আলোচনা করতে পারি।
- গ্রীক-রোমান- গ্রীক-রোমান এর আদি রচয়িতাদ্বয় ছিলেন ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস ও টেসিয়াস। তাদের গ্রন্থ থেকে তৎকালীন পারসীক আক্রমণ বিষয়ে জানতে পারি। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমনের বিবরন গ্রীক রোমান লেখক ফার্টিয়াস, এরিয়ান, ডায়োডোরাস প্রমুখের রচনায় পাওয়া যায়। এছাড়া গ্রীক দূত মেগাস্হিনিসের 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে মৌর্যযুগের বিবরন পাওয়া যায়।
- চৈনিক বিবরন- চিনের লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সু -মা-সিয়েন, ফা-হিয়েন, হিউয়েন-সাঙ, ই-সিং। সু-মা-সিয়েন রচিত ইতিহাস গ্রন্থে ভারতে বহু মূল্য তথ্য পাওয়া যায় । ফা- হিয়েন রচিত 'ফো-কুও-কি' থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আমলের বিবরন পাওয়া যায়। হর্ষবর্দ্ধনের রাজত্বকালে আগত হিউয়েন-সাঙ রচিত 'সি-হউ-কি' সমসাময়িক ভারতবর্ষের বহু তথ্য জানা যায়। এছাড়াও পরিব্রাজক ই-সিং ভারতে 673-695 AD পর্যন্ত ছিলেন।
- আরবীয় বিবরন- আরব দেশ থেকেও বহু পর্যটক ভারতে এসেছিল যেমন আলবিদূরী, আলমাসুদী, হাসান নিজাম, এবং সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য আলবেরুনী ও তার গ্রন্থ 'তহকিক- ই- হিন্দ' থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের ও তার শিক্ষা - সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায়।
সীমাবদ্ধতা- প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদানগুলির কিছু সিমাবদ্ধতা রয়েছে।
- ধর্মাশ্রয়ী গ্রন্থ গুলিতে ঐতিহাসিক তথ্য গুলি ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত থাকায় সেগুলি থেকে প্রাচীন যুগের পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি অংকন করা কষ্টসাধ্য।
- ঐতিহাসিক সাহিত্যের মধ্যে পুরানের গুরুত্ব প্রতীয়মান হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য বেশ কম। মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণে বর্ণিত অনেক ঘটনা কল্পনা প্রসূত ও অতিরঞ্জিত দোষে দুষ্ট।
- বিভিন্ন রাজাদের জীবনী গুলির লেখকগন প্রায় সকলে রাজানুগ্রহভাজন হওয়ায় নিরপেক্ষভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেননি
- বৈদেশিক পর্যটকদের রচনাতেও ক্রটি ছিল। অধিকাংশ লেখক স্থানীয় ভাষা ও আচার কানুন জানতেন না। যার ফলে তারা প্রায় ভুল সংবাদ নথিভুক্ত করেছেন।
সাহিত্যিক উপাদানের নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এর ঐতিহাসিক মূল্য একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কোন যুগে সাহিত্যিক উপাদানের উপযোগীতা বেশী আবার অন্য যুগে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হয়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের বিশ্বাসযোগ্যতা যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি তা বলাই বাহুল্য।
উপসংহার — বিভিন্ন সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সমন্বয়ে প্রাচীন ভারতের ধারাবাহিক যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়েছে । তবে সাহিত্যিক উপাদানগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জনের হাতে পড়ে নানা সময়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে । তাই সাহিত্যিক উপাদানগুলি ব্যবহারের সময় খুবই সচেতন থাকতে হয় । কোনো সাহিত্যিক উপাদানের তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের দ্বারা সমর্থিত হলে তা নিশ্চিত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা যায় । সাহিত্যিক উপাদানের এই ত্রুটি দূর করার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে অসুবিধা নেই ।
উপসংহার — বিভিন্ন সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সমন্বয়ে প্রাচীন ভারতের ধারাবাহিক যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়েছে । তবে সাহিত্যিক উপাদানগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জনের হাতে পড়ে নানা সময়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে । তাই সাহিত্যিক উপাদানগুলি ব্যবহারের সময় খুবই সচেতন থাকতে হয় । কোনো সাহিত্যিক উপাদানের তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের দ্বারা সমর্থিত হলে তা নিশ্চিত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা যায় । সাহিত্যিক উপাদানের এই ত্রুটি দূর করার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে অসুবিধা নেই ।
No comments